Thursday, March 8, 2018

১৪ ফেব্রুয়ারি ও আমরা

আঠারশ শতকের প্রথম দিকে ব্রিটিশরা যখন এই দেশে চা খাওয়ার প্রবর্তন করে, তখন ব্রিটিশ লর্ডরা সহজ সরল বাঙালিদের দাওয়াত করে বিনে পয়সায় চা খাইয়েছে, কুঠিতে ডেকে নিয়ে। আস্তে আস্তে বাঙালিদের মধ্যে গড়ে ওঠে চা খাওয়ার কামুক ন্যায় অভ্যাস। চাইলেও ছাড়তে পারে না, এই অভ্যাস। তখন বিনে পয়সায় খাওয়ার দিন শেষ। তারপর ঐ চা বাঙালিদের কিনে খেতে হয় ব্রিটিশদের কাছে থেকে। তাও অনেক গুণ চড়াও মূল্যে। পরবর্তীকালে জমি বন্ধক রেখেও বাঙালির চা খাওয়ার ইতিহাস আছে। এখনো খাচ্ছে। ক্যাফেইন তাদের ঘুম কমায়, ট্যানিন আয়রন এবসোর্পশন বন্ধ করে দিলেও তাদের কোনো মাথা ব্যাথা নাই।
“হুজুগে বাঙালি” শব্দটি বোধ হয় এসব কারণেই এসেছে। আমাদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে গেছে অন্ধ, অনুকরণ । দুরদর্শী চিন্তার অভাব,পাশ্চাত্যের অন্ধ অনুকরণে, বারংবার নিজ সংস্কৃতি ও জাতিগত ঐতিহ্যের ললাটে অপমান আর কলঙ্ক তিলক আঁকতে আমরা দ্বিধা করিনি কখনো। অথচ বাঙালি জাতির নিজেরই রয়েছে সমৃদ্ধ গৌরবজ্জল ইতিহাসের সুবিশাল ক্যানভাস। আত্মবিস্মৃত বাঙালির অনুকরণ প্রবণতার সাম্প্রতিকতম নজির হল ভ্যালেন্টাইন ডে।

পুঁজিবাদী এই বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় সব কিছুকেই নিয়ন্ত্রণ করছে পুঁজি। নিজ স্বার্থে পুঁজি মানুষের ওপরে স্থান দেয় বিক্রয়যোগ্য পণ্য দ্রব্যকে। সবার ওপরে পণ্য সত্য। পণ্যের সম্প্রসারিত অংশ হিসাবেই মানুষের গুরুত্ব। মানুষের যে ক্রিয়া, মেধা, শ্রম, শরীর পণ্য অর্থনীতির সম্প্রসারণ হতে অস্বীকার করে তখন তা এমনিতে যতই গুরুত্বপূর্ণ মনে হোক না কেন, তার শিল্পমান, গভীরতা, প্রয়োজনীয়তা যাই থাকুক না কেন, এই অর্থশাস্ত্র তাকে হিসাবের মধ্যে কখনই নেবে না। বিশ্বের শত কোটি মানুষ আজ যে বিশ্বায়নের প্রবাহের মধ্যে আছে,তার ফলশ্রুতিতে ভৌগলিক রাষ্ট্রীয় সীমা, সার্বভৌমত্ব দ্রুত আনুষ্ঠানিক ব্যাপারে পরিণত হচ্ছে। পুঁজিবাদের প্রভুদের চাপিয়ে দেয়া আচার, সংস্কৃতি অধীনস্ত জাতিগুলি গ্রহণ করছে কখনো সচেতনভাবে, কখনো অবচেতনভাবে। এই স্রোতধারায় গা ভাসানোয় আমরা বাঙালিরা যেন  একটু বেশীই উৎসাহ দেখিয়ে থাকি।
যুদ্ধবাজ রোমান সম্রাট দ্বিতীয় কডিয়াস ২৭০ খ্রিস্টাব্দে রোমান তরুণ যুবকদের যুদ্ধে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে সব বিয়ে ও বাগদান বেআইনি এবং বাতিল ঘোষণা করেন। সম্রাটের এই নিপীড়নমূলক আইনের বিরুদ্ধাচারণ করেই শহীদ হয়েছিলেন সেইন্ট ভ্যালেন্টাইন। এই ইতিহাস বলছে, মানুষ শুধু নিজের জন্য বাঁচে না। সেন্ট ভ্যালেন্টাইন এর বড় উদাহরণ।
তবে আজকের যুগে ভ্যালেন্টাইন ডে মানে কপোত-কপোতী 'হু আহা' টাইপের ভালোবাসা আর 'আমি-তুমি'র স্বপ্ন দেখা। ভ্যালেন্টাইনের প্রতিরোধ সংগ্রামকে যখন ব্যক্তিকেন্দ্রিক আমি-তুমির ভালোবাসায় রূপান্তর করা গেছে তখনই কিন্তু আমি-তুমির ওপর ভর করে কোটি কোটি টাকার পণ্য বিক্রির বাজারও নির্দিষ্ট করা গেছে। এই বাজার শুধু ইউরোপ বা যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি, তার গন্ডি মহাদেশ থেকে মহাদেশ ছাড়িয়ে আমাদের  দেশেও এসে পড়েছে।
তবে ইতিহাস বলে দেয়, হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতির এই জনপদে মানুষের উৎসবের কোনো ঘাটতি কোন কালেই ছিল না। ১২ মাসে ১৩ পার্বণ আর হাসন রাজা, রাধারমন ,বাউল শাহ আব্দুল করিমের দেশে ভ্যালেন্টাইনের কাছ থেকে আমাদের ভালোবাসা শিখতে হবে! এর থেকে আর দুঃখের, অপমানের কী আছে! আর যখন সেই ভালোবাসা শুধু 'আমি', 'তুমি'র মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে, তখন তা ভ্যালেন্টাইনের জন্যও কী নিদারূণ অপমানের বৈকি! লাখো শহীদের রক্তে অর্জিত বাংলাদেশে , ১৪ ফেব্রুয়ারি, ১৯৯২ সাল পর্যন্তও পালিত হয়েছে স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস হিসেবে। অথচ মাত্র এক দশকের মধ্যেই সেই রক্তাক্ত  প্রতিরোধের দিন পরিবর্তিত হয়ে যায় 'ভালোবাসা দিবস' নামে।
দৃষ্টিকে গভীর করে এর পেছনের কারণ খুঁজলে দেখবো বাজার সভ্যতার এক সুবিশাল রামরাজত্ব। পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থা এমনই এক বিশ^ সৃষ্টি করেছে যেখানে, সমাজ থেকে ব্যক্তিকে বিচ্ছিন্ন করে তাকেই আবার সমাজের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে দেয়। ব্যক্তিকে ছুটিয়ে দেয় নিরন্তর ভোগের দিকে। যার মধ্যে ব্যক্তি হয়ে ওঠে পুঁজি পণ্যে মুনাফা করার মেশিন। এই মুনাফা যত বৃদ্ধি পায়, পুঁজিপতির হাত তত শক্তিশালী হয় আর বিপরীতে ব্যক্তি হয়ে ওঠে আরো বিচ্ছিন্ন সত্ত্বা, একা, নিঃসঙ্গ মানুষ। এই সুযোগটিই আবার কাজে লাগায় পুঁজিপতিরা তাদের মুনাফা দ্বিগুণ করার মওকা হিসেবে। পুঁজি তখন বিভিন্ন সামাজিক অনুষঙ্গ তৈরি করে ব্যক্তির একাকিত্ব ঘোচানোর জন্য। তৈরি হয় পর্নো ব্যবসা, পর্নো বাজার। পৃথিবীতে এই মুহূর্তে বৃহৎ আর্থিক খাতের অন্যতম হলো পর্নো ব্যবসা। যে সামাজিক অভিঘাত থেকে ব্যক্তি একা-নিঃসঙ্গ হয় সেই সমাজপতিরা আবার সেই সুযোগে ব্যবসা হাতিয়ে নেয়। একদিকে পরিবার, প্রেম, বিবাহ ভেঙে পড়ছে পশ্চিমা ধনতান্ত্রিক দেশগুলোতে। আবার অন্যদিকে ভালোবাসার জন্য আলাদা দিবস তৈরি করে তাকে ভালোবাসার ফাঁদে ফেলে ব্যবসা করার পথ তৈরি করছে।
বিশ শতকের গোড়ার দিকে (১৯১০) জয়েস সি হলমার্ক যখন হলমার্ক নামের দোকান খুলে কার্ড ব্যবসা শুরু করেন, হলমার্ক তার কার্ড বিক্রির জন্য বিশেষ কৌশল অবলম্বন করেছিল; তা হলো মানুষের আবেগ-অনুভূতি মর্মস্পর্শী করে কার্ডে প্রকাশ করা। আর এর মধ্য দিয়ে কার্ডের ওপর কবিতা, অনুভূতি ছাপা হতে শুরু হলো। নিঃসঙ্গ মানুষও হুড়মুড় করে কিনতে শুরু করল। মানুষের ভালোবাসা বিক্রি করা শুরু করল হলমার্ক।
অতীতের মতো আজকের নাগরিক মানুষ ভালোবাসার  প্রতি তীব্র আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করে না প্রিয়তমার জন্য। তবে ক্ষেত্র বিশেষে এরও ব্যতিক্রম আছে। পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থা শেষ পর্যন্ত ভালোবাসার মতো কোমল অনুভূতিও ভোঁতা করে দিচ্ছে। আর এই সুযোগে 'ডে'নির্ভর ভালোবাসার প্রচলন শুরু হয়েছে। যার স্রষ্টা বহুজাতিক কোম্পানিগুলো। যুদ্ধবাজ রোমান সম্রাট দ্বিতীয় ক্লডিয়াসের স্বৈরাশাসনের আদেশের বিরুদ্ধে যে জীবন আত্মোৎসর্গিত করেছিলেন সাধু ভ্যালেন্টাইন সম্মিলিত মানুষের ভালোবাসার প্রতি ভালোবাসা দেখিয়ে; সেই ভালোবাসা থেকে আজকের ফেসবুক, টুইটারের যুগের ভ্যালেন্টাইন  অনেক দূরে।

১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ লে. জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ এক রক্তপাতহীন অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করেন। রাজনৈতিক দলগুলো এরশাদের এভাবে ক্ষমতা দখলকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা না করে অনেকটাই নীরবে মিলিটারি স্বৈরশাসন মেনে নেয়। রাজনৈতিক দলগুলো মেনে নিলেও ছাত্ররা মেনে নেননি এই সামরিক অভ্যুত্থান। সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধ গড়ে ওঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। স্বৈরাচার এরশাদ ক্ষমতায় ছিলেন আট বছর ২৫৬ দিন। এ সময় দেশের হাজার হাজার মানুষ স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন করতে গিয়ে কারাবরণ করেছে। হত্যা-গুমের শিকার হয়েছে অসংখ্য নারী-পুরুষ। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। বিশেষত ১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি মিছিলে পুলিশের গুলিতে ছাত্র নিহত হওয়ার পর থেকেই দেশব্যাপী আন্দোলন গড়ে ওঠে।
১৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাত্রজনতা মিছিল বের করলে হাইকোর্টের গেট ও কার্জন হল সংলগ্ন এলাকায় পুলিশের ব্যারিকেডের সামনে পড়ে। তখন মেয়েরা ব্যারিকেডের সামনে বসে পড়েন। নেতারা তারকাঁটার ওপর ওঠে বক্তৃতা দিতে শুরু করেন। মিছিলটি ছিল হাইকোর্টের গেট থেকে বাংলা একাডেমী পর্যন্ত। কোনো উষ্কানি ছাড়াই তারকাঁটার একদিক কিছুটা সরিয়ে রায়ট কার ঢুকিয়ে রঙিন গরম পানি ছিটাতে শুরু করে পুলিশ। এরপর ভেতরে ঢুকে বেধড়ক লাঠিপেটা শুরু করে। সাধারণ ছাত্ররা তখন এদিক-সেদিক ছোটাছুটি করে পুলিশের দিকে ইটপাটকেল ছুড়তে শুরু করেন। পুলিশ তখন ছাত্রদের উপর গুলিবর্ষণ করে। এ সময় গুলিবিদ্ধ হন জয়নাল। সেদিন জয়নালকে গুলিবিদ্ধ করেই ক্ষান্ত হয়নি, তাঁর শরীর বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে পুলিশ। শুধু জয়নাল নন, ছাত্রদের ওপর পুলিশি তান্ডবের সময় শিশু একাডেমীতে একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে আসা দিপালী নামের এক শিশু গুলিবিদ্ধ হয়। তবে দিপালীর লাশ পুলিশ গুম করে ফেলে। জয়নাল পড়েছিলেন কার্জন হলের মধ্যে। তাঁকে ঢাকা মেডিক্যালে নেওয়া হলে চিকিৎসকরা মৃত ঘোষণা করেন। সেই থেকে ১৪ ফেব্রুয়ারি পালিত হতে থাকে স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস হিসাবে।
কিন্তু দুঃখের বিষয় আন্দোলনের দুই যুগ পার হতে না হতেই জনগণের কাছে বিস্মৃত হতে চলেছে জয়নাল-দিপালীদের নাম। আমি-তুমি টাইপের ব্যক্তির ভালোবাসায় পরিণত হয়েছে স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস। ১৯৯২ সাল পর্যন্ত দিনটিতে বাংলাদেশের ছাত্রসমাজ স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস হিসেবেই পালন করে আসছিল। নব্বই পরবর্তী মুক্তবাজার অর্থনীতির প্রবল জোয়ারে দিনটি পরিণত হয়েছে বহুজাতিক কোম্পানির পণ্য বিক্রির দিন হিসেবে।
ভালবাসার জন্য দিবস হতেই পারে, কিন্তু তা হতে হবে কৃত্রিমতাবর্জিত,ব্যবসায়িক দুরভিসন্ধিমুক্ত। লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে নয়। নিজ ইতিহাসের গৌরবের পতাকা পদতলে পিষ্ট করে,নিজ শিকড়কে ভুলে অপরের অন্ধ অনুকরণে কোন গৌরব নেই,বরং তা কেবলই লজ্জা,গ্লানি আর অপমানের বোঝাকে ভারি করে তোলে এতে কোন সন্দেহ নেই।
সংগৃহীত

No comments:

Post a Comment

                                                  আমাদের বাংলাদেশ বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা